একই সঙ্গে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ, তার বিপরীতে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। এর ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও (বিপিসি) লাভ বাড়বে, একই সঙ্গে মুনাফা বাড়বে প্রভাবশালী পরিবহনমালিকদেরও। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘উইন-উইন’ খেলা। তবে সরকার ও পরিবহনমালিকদের একই ফ্লাটপর্মে কাজ করার এই উদ্যোগ অতুলনীয়।
তবে তিন দিন ধরে ঘটনাগুলো যে ভাবে ঘটানো হয়েছে, তাতে বলাই যায়, এ ছিল পরিবহনভাড়া বাড়ানোর এক পাতানো খেলা। তা নাহলে এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১৫ টাকা বাড়ার কথা নয়। দেশে এর আগে এক লাফে এতটা দাম কখনোই বাড়ানো হয়নি।
আরো পড়ুন: ডিজেলর দাম না বাড়িয়ে আর যে সব বিকল্প ছিল
আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, ১৯৭৫ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। ওই দিন এক ধাক্কায় টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল প্রায় ৫৮ শতাংশ। এর পর আরো অনেকবার টাকার অবমূল্যায়ন করা হলেও তা ছিল অল্প অল্প মাত্রায়। একলাপে ৫৮ শতাংশের মতো বড় মাত্রায় টাকার অবমূল্যায়নের পথে আর কখনো যায়নি বাংলাদেশ।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবার টাকার অবমূল্যায়ন করেছে। বেশির ভাগ সময়েই টাকার এই অবমূল্যায়নের হার ছিল ৫০ পয়সা করে। অবমূল্যায়ন করলে রপ্তানিকারকেরা লাভবান হন, আমদানি খরচ বেড়ে যায়।
যার কারণে মাত্রাতিরিক্ত এবং বেশি হারে অবমূল্যায়ন করা হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তাই দেশের ভোক্তা বা সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে প্রতিবারই মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
সরকার নির্ধারিত কোনো কিছুর দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি কথা সব সময়েই মাথায় রাখে। যেমন ‘সহনীয় মাত্রা’ ও ‘সমন্বয়’। অর্থাৎ সরকার কোন কিছুর দাম বাড়ায় বা কমায় না, তারা চেষ্টা করে কেবল সমন্বয় করতে এবং তা-ও সহনীয় মাত্রায়। আর দাম বাড়ালে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে যতবার টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, যতবার পানি বা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাসের মূল্য বৃ্দ্ধি করা হয়েছে, ততবারই সরকারের পক্ষ থেকে একই কথা বলা হয়েছে।
আরো পড়ুন: ডিজেলর দাম না বাড়িয়ে আর যে সব বিকল্প ছিল
তবে ভোজ্যতেল বা চিনির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কৌশল একটু অন্যরকম। যখন বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যায়, তখন সামান্য লাভ বা সামান্য লোকসান হয়, এমন একটা দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়। এতে ব্যবসায়ীরা খুব একটা উচ্চবাচ্য করেন না।
কারণ, বিশ্ববাজারে যখন ভোজ্যতেল বা চিনির দাম কমে যায়, তখন সরকার বাড়তি দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা পূর্বের ক্ষতি কাটিয়ে ঠিকই বড় অঙ্কের লাভ করেন। এই নীতি চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
তাহলে হঠাৎ সরকার কেন ডিজেল আর কেরোসিন তেলের দাম মাত্রাতিরিক্তভাবে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিল? একধাপে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ইতিহাস আর নেই। অথচ গত সাত বছরে সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা লাভ করেছে।
এই সাত বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারেরও কম। এর মধ্যে আবার এক বছর আগে তা শূন্যেও নেমে এসেছিল। যার কারণে বিপিসির লাভ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কেননা এ সময় সরকার জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সাথে সমন্বয় করে কমায়নি। শুধুমাত্র চক্ষুলজ্জার জন্য অথবা জনগণকে একধরণের ধোকা দেওয়ার জন্য ২০১৬ সালে সামান্য কমানো হয়েছিল। যেমন ডিজেল ও কেরোসিনে দাম কমেছিল লিটারে মাত্র ৩ টাকা আর অকটেন ও পেট্রলে মাত্র ১০ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো আগের লোকসান কাটিয়ে উঠতে তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছে।
যার ফলশ্রুতিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় হুট করে এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনে দাম ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে দিল। অর্থাৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিপিসির উচ্চমাত্রার লাভ ঠিকই থাকল, তাদের একটাকাও লোকসান হবেনা। ফলে এবার আর সহনীয় পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির কোনো আলোচনা শোনা যাচ্ছেনা।
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বৃদ্ধি, পরিবহনভাড়া বাড়ানোর জন্য পাতানো খেলা কি না? সে প্রশ্ন অবান্তর নয়। কেননা, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়, ধর্মঘটে যান সব ধরনের পরিবহনমালিকরা। তবে পরিবহন খাতের বড় নেতা ও নিয়ন্ত্রক, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান অবশ্য সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটা কোন ধর্মঘট নয়, লোকসান হবে বলেই পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় এতটা বোকা নয় যে, তাদের জানা ছিলনা, এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ালে পরিবহন খাতে কী প্রতিক্রিয়া হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বা লঞ্চমালিকেরা এই সুযোগ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিল। তারা অনেক দিন ধরেই ভাড়া বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরণের পাঁয়তারা করছিলেন। আর সরকারও সময়মতো সেই সুযোগটা করে দিল। বিষয়টা অনেকটা ক্রিকেটের ফুলটস বলের মতো।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় ফুলটস একটি বল দিয়েছে আর পরিবহনমালিকেরা মারলেন ছক্কা।কিন্তু বেচারা দর্শকদের তো এখন মাঠের গ্যালারিতে বসার সুযোগও নেই।
অবশ্য গ্যালারিতে দর্শক থাকল কি না, তাতে সরকারের কোন কিছুই আসে যায়না। কারণ, এসব সাধারণ মানুষ তো ভোটারের মর্যাদা বা সম্মান আগেই হারিয়ে ফেলেছে।
যেহেতু জ্বালানি তেলের দামের সাথে অন্যান্য সকল কিছু সম্পর্কিত তাই এখন কেবল যে পরিবহনভাড়া বাড়বে তা নয়, বাড়বে পণ্যের উৎপাদন খরচ, এর প্রভাব পড়বে বাজারে। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা হবে অসহনীয়।যেখানে সারা বিশ্ব এখন মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। সেখানে আমাদের সরকার সেই চাপটাই আরও ব্যস্ত।